১৯৪৭ সালের দেশভাগ নিঃসন্দেহে বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে মর্মঘাতী ক্ষত, গাঁধীর মতো কেউ-কেউ যাকে তুলনা করেছিলেন জীবিত প্রাণীর শবব্যবচ্ছেদের অসহ্য যন্ত্রণার সঙ্গে। উপমহাদেশের চার প্রজন্মের মানুষের মনস্তত্ত্বকে এ ঘটনা তাপদগ্ধ ও অসাড় করে দিয়েছে। কেন আদৌ এ ঘটনা ঘটেছিল? এ জন্য দায়ীই বা কে? জিন্না? কংগ্রেস? না কি ব্রিটিশরা? যশোবন্ত সিংহ এ প্রশ্নেরই একটা উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছেন। একান্তভাবেই তাঁর নিজস্ব উত্তর। কেননা প্রশ্নটির সম্ভবত কোনও নির্দিষ্ট একটা উত্তর হয় না। লেখক তবু তাঁর অনুসন্ধান চালিয়েছেন। জিন্নার রাজনৈতিক অভিযাত্রা শুরু হয়েছিল(গোপালকৃষ্ণ গোখলের ভাষায়) ‘হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের রাষ্ট্রদূত’ রূপে। কিন্তু তা শেষ হয় ভারতীয় মুসলিমদের ‘একমাত্র মুখপাত্র’, পাকিস্তানের স্রষ্টা এবং কায়েদ-এ-আজম হয়ে ওঠায়। কেন এবং কী ভাবে এই রূপান্তর ঘটল?কোনও ভারতীয় বা পাকিস্তানি রাজনীতিক কিংবা সাংসদ কায়েদ-এ-আজম মহম্মদ আলি জিন্নার নিরপেক্ষ, বিশ্লেষণধর্মী রাজনৈতিক জীবনী রচনা করার চেষ্টা করেননি- তাঁর সম্পর্কে বেশির ভাগ লেখাতেই হয় তাঁকে দেবতা প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করা হয়েছে, অথবা দানব। এই বইতে জিন্নার বস্তুনিষ্ঠ মুল্যায়নের চেষ্টা রয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রী ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হিসাবে যশোবন্ত সিংহের অভিজ্ঞতা অতিশয় সমৃদ্ধ(লাহৌর শান্তি প্রক্রিয়া, কার্গিলে যার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়, কন্দহরে সন্ত্রাসবাদীদের মুক্তির বিনিময়ে ভারতীয় বিমানযাত্রীদের নিরাপদে ফেরানো, আগ্রার শীর্ষ শান্তি বৈঠক, জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভা ও ভারতীয় লোকসভায় জঙ্গি হামলা, ২০০২ সালে যুদ্ধপ্রস্তুতির আড়ালে চাপ সৃষ্টির কূটনীতি এবং পরের বছরেই আবার শান্তি-উদ্যোগের একের-পর-এক চ্যালেঞ্জ তাঁর সামনে এসেছে)।যশোবন্ত প্রশ্ন তুলেছেন, ‘মুসলিমরা একটি স্বতন্ত্র জাতি’, এই বিতর্কিত তত্ত্বটির কোথায় এবং কবে উৎপত্তি হল এবং ভারতীয় উপমহাদেশকেই বা তা কোথায় নিয়ে গেল? পাকিস্তানকে কী দিল এই তত্ত্ব? বাংলাদেশ। তবে কেন তৈরি হল? এখনই বা পাকিস্তান কোন পথে চলেছে? এ বই সত্যিই বৈশিষ্ট্যপূর্ণ, কেননা এটি এমন একজন লিখেছেন যিনি কেবল নীতির অনুশীলনকারী নন, নীতিপ্রণেতাও, এবং যিনি নির্দিষ্ট উত্তর সন্ধান করেন। গত ৬২ বছরের এই জ্বলন্ত প্রশ্নগুলো আজও আমাদের সম্মোহিত করে রেখেছে। যশোবন্ত সিংহের বিশ্বাস, দক্ষিণ এশিয়ায় স্থায়ী শান্তি ফেরাতে গেলে আগে বুঝতেই হবে, কেন প্রথমত এই শান্তি আমাদের ছেড়ে গেল? যতক্ষণ এই ন্যূনতম, অত্যাবশ্যক, অবিকল্প কৃত্যটি সাঙ্গ না হয়, ততদিন এখানে শান্তির প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা নেই।