ভগিনী নিবেদিতা (পূর্বনাম মাগারেট ই নোবল : ১৮৬৭-১৯১১) স্বামী বিবেকানন্দের শিষ্যা, ভারত-ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ যুগের ধাত্রী-জননী। নিবেদিতা কী ছিলেন এবং কী করেছিলেন, তার অর্ধাবৃত ইতিহাসকে বিপুল পরিশ্রমে, বহু অজানিত তথ্যসহ এই গ্রন্থে লেখক উন্মোচন করেছেন। সমসাময়িক সংবাদপত্র, দুর্লভ গ্রন্থ, নানা স্মৃতিকথা ছাড়াও নিবেদিতার পাঁচ শতাধিক অপ্রকাশিত পত্র থেকে উপাদান সংগৃহীত। ডঃ জগদীশচন্দ্র বসু, স্বামী সারদানন্দ, রমেশচন্দ্র দত্ত, বি এম মালাবারি, জি কে গোখলে, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, প্রিন্স ক্রপটকিন, এস কে র্যাটক্লিফ, উইলিয়াম স্টেড, মিস ম্যাকলাউড, মিসেস ওলি বুল, জেন অ্যাডামস্, লেডী ইসাবেলা মার্গাসন, ই টি স্টার্ডি, মিস লংফেলো প্রমুখ বহু বিশিষ্ট নরনারীর পত্রও গ্রন্থে আছে। মূল্যবান তথ্যগুলির প্রামাণিকতা দেখানোর জন্য প্রচুর সংখ্যায় চিত্র ও প্রতিলিপি দেওয়া হয়েছে। বিবেকানন্দের বাল্যবন্ধু প্রিয়নাথ সিংহ অঙ্কিত বহুবর্ণ চিত্রটি এই গ্রন্থের সম্পদ। স্বামীজীর দেহত্যাগের পূর্বে নিবেদিতার এক সপ্তাহের দিনলিপির প্রতিলিপিও তাই। নানা খণ্ডের এই বই। সুবৃহৎ প্রথম খণ্ডটির প্রথম সংস্করণ পাঠকদের সুবিধার জন্য দ্বিতীয় সংস্করণে দুই পর্বের দুটি পৃথক পুস্তকরূপে প্রকাশিত। এর প্রথম পর্বের প্রথম ভাগ : “রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের নিবেদিতা।” তাতে নিবেদিতার আধ্যাত্মিক জীবন, রামকৃষ্ণমণ্ডলীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক, শ্রীরামকৃষ্ণ ও সারদাদেবী ও বিবেকানন্দ সম্বন্ধে উৎকৃষ্ট রচনার সংকলন, সর্বোপরি স্বামী বিবেকানন্দের ধর্ম-জ্বলন্ত মূর্তি। নিবেদিতার চিঠিতে বিবেকানন্দের যে উদ্দীপিত একান্ত রূপের সাক্ষাৎ মেলে, পৃথিবীর অধ্যাত্ম-ইতিহাসে তা মূল্যবান সংযোজন। এই পর্বের দ্বিতীয় ভাগ : “মৃত্যুরূপা কালী।” এতে বিবেকানন্দের অসাধারণ ‘মৃত্যুদর্শন’, নিবেদিতার কালী-বক্তৃতা, তার সম্বন্ধে তীব্র সামাজিক প্রতিক্রিয়ার কাহিনী। বিবেকানন্দ-সূত্রে অধ্যাত্মরাজ্যের কিছু ‘গোপন দলিল’ও প্রথম লোকলোচনে আনা হয়েছে। প্রথম খণ্ডের দ্বিতীয় পর্বের প্রথম ভাগ : “পূর্ব জীবন।” স্বামীজীর সঙ্গে সাক্ষাতের আগেই যে, নিবেদিতা লণ্ডনের বিদগ্ধমহলে প্রতিপত্তি অর্জনের পথে এগিয়েছিলেন তথ্যযোগে তা প্রদর্শিত। নিবেদিতার প্রথম জীবনের ১৫টি দুষ্প্রাপ্য লেখাও মূলে ও সারানুবাদে প্রদত্ত। অন্তরঙ্গ নিবেদিতার দুর্লভ চিত্র এখানে। বিশ্ব তাঁর ঘর হলেও ঘরের বিশ্বেও তাঁর নিবিড় অবস্থান—তা দেখা যায় পিতা মাতা ভ্রাতা ও ভগিনীর সঙ্গে সম্পর্কসূত্রে। এর দ্বিতীয় ভাগ : “নিবেদিতা ও জগদীশচন্দ্র।” আচার্য জগদীশচন্দ্রের আবিষ্কার, ভারতে বিজ্ঞান-আন্দোলন, বসুর জীবন ও সাধনায় নিবেদিতার প্রেরণালক্ষ্মীর ভূমিকা। আচার্যের বিজ্ঞানসাধনায় স্বামীজীর উৎসাহ, তাঁর সঙ্গে স্বামীজীর বন্ধুত্ব, স্বামীজীর দুই শিষ্যা মিসেস ওলি বুল ও মিস ম্যাকলাউডের সহায়তা বসুর বিজ্ঞানে। প্রচুর অজানিত উপাদানের সাহায্যে রচিত এই অংশটিকে জগদীশচন্দ্রের উপর পৃথক গবেষণাও বলা চলে। গ্রন্থের দ্বিতীয় ও তৃতীয় খণ্ডে ভারতের জাতীয় আন্দোলনে নিবেদিতার ব্যাপক ভূমিকার কথা। স্বদেশী আন্দোলন, নিবেদিতার প্রকাশ্য ও গোপন রাজনৈতিক কার্যকলাপ, ছদ্মবেশে দেশ-বিদেশে ভ্রমণ, অগ্নিবর্ষী রচনা, সরকারী সাহেবমহলে ঘোর দুর্নীতি, দেশপ্রেমিকদের উপর নিষ্ঠুর অত্যাচার, রামকৃষ্ণ মিশনের উপর সরকারের আক্রোশ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে নিবেদিতার যোগাযোগ, ইত্যাদি বিষয়ে চাঞ্চল্যকর অজানা সংবাদ। চতুর্থ খণ্ডের বিষয়—ভারতীয় কলাশিল্প আন্দোলনের ইতিহাস ও তাতে নিবেদিতার নেত্রীত্ব। শেষ খণ্ডের বিষয় : ভারতীয় সংস্কৃতির শক্তি ও সৌন্দর্য বিশ্লেষণে নিবেদিতার বিখ্যাত বইগুলির মূল্য; নারীশিক্ষা ও সমাজসেবা আন্দোলনে তাঁর কর্ম ও প্রেরণা; ভারত ও পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মনীষীদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ; সমসাময়িক পত্র-পত্রিকায় তাঁর সংবাদ। রবীন্দ্রনাথ ও নিবেদিতা সম্পর্কে একটি বিশেষ অধ্যায়। এছাড়া আরো অজস্র সংবাদ, নিবেদিতার রচনার উৎকৃষ্ট বহু অনুবাদ। ঊনিশ শতকের শেষ ও বিশ শতকের গোড়ার দিকে ভারতের সাংস্কৃতিক ইতিহাস জানতে হলে এই আকর গ্রন্থটি অপরিহার্য। নিঃসন্দেহে বলা যায়, এই গ্রন্থ ভাব ও চিন্তার নৈরাশ্যের ও নৈরাজ্যের যুগে চির আশাবাদী, চির সংগ্রামী এক প্রতিভাময়ী নারীর জীবনসাধনার সঙ্গে আমাদের পরিচয় ঘটিয়ে ভারতাত্মা ও বিশ্বাত্মার সঙ্গে যোগস্থাপনে সহায়তা করবে। অজস্র দুর্লভ ঐতিহাসিক চিত্র।