গবেষকের তথ্যনিষ্ঠা, ঐতিহাসিকের সত্যদৃষ্টি ও সাহিত্যিকের মনীষার এক দুর্লভ ত্রিবেণী-সঙ্গম শঙ্করীপ্রসাদ বসুর ‘নিবেদিতা লোকমাতা’ নামের এই অক্লান্ত সাধনাসিদ্ধ মহাগ্রন্থে। খণ্ড পরিচয় নয়, ভগিনী নিবেদিতার সামগ্রিক এক পরিচয়ই এই গ্রন্থের খণ্ডে-খণ্ডে তুলে ধরে চলেছেন অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসু। সেই অসামান্য গ্রন্থেরই তৃতীয় খণ্ড প্রকাশিত হল। ভারতের জাতীয় আন্দোলনের রাজনৈতিক ও সামাজিক অংশে নিবেদিতার যে-অনন্য ভূমিকা, তারই সন্ধান-পর্বের সমাপ্তি এই পর্বে। এদেশে নিবেদিতার কার্যকাল মাত্র এক দশকের, কিন্তু ব্যাপ্তি ও গভীরতায় তা এই সময়সীমাকে বহুদূর অতিক্রম করে গিয়েছে। নিবেদিতার বিপুল-সংখ্যক পত্রাবলী ও সেই সূত্রে অন্যত্র সন্ধান করে প্রাপ্ত সংবাদ, সমূহ রচনা, বিভিন্ন স্মৃতিকথা, সমকালীন পত্র-পত্রিকার সাক্ষ্য-বলা যায় একেবারে মন্থন করে শঙ্করীপ্রসাদ তুলে এনেছেন এতকাল-অজ্ঞাত এক নতুন ও চমকপ্রদ নিবেদিতা-মূর্তিকে। দেখিয়েছেন, স্বদেশী-আন্দোলনে এই মহীয়সীর যথার্থ ভূমিকাটি কী ছিল। দেখিয়েছেন এ-দেশে বিপ্লবীদের উপর চরম অত্যাচার, ব্যক্তিস্বাধীনতা হরণ, সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ—প্রভৃতি খবর কীভাবে ইংলণ্ডে লিখে পাঠাতেন নিবেদিতা, কীভাবে সেখানে স্বদেশী-আন্দোলনের পক্ষে সংগঠন করেছেন তিনি, কীভাবে ‘স্টেটসম্যান’ পত্রিকাকে করে তোলেন জাতীয়তাবাদী (যার ফলে তৎকালীন সম্পাদক হন অপসৃত), শ্রীঅরবিন্দের গ্রেপ্তার রোধে এদেশে-বিদেশে কীভাবে প্রয়াস চালিয়েছেন এবং শ্রীঅরবিন্দের পলায়নে কী ভূমিকা নেন তিনি, পুলিশ কমিশনার থেকে শুরু করে লেফটন্যান্ট গভর্নর জেনারেল পর্যন্ত উচ্চপদস্থ ইংরেজ কর্মচারীকে কীভাবে উৎকোচ-গ্রাহী রূপে চিত্রিত করেছেন, উদারনৈতিক ভারতসচিব লর্ড মর্লের চরিত্র সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাকে কীভাবে বদলে দিয়েছেন নিবেদিতা। দেখিয়েছেন, কী গভীর ইতিহাসবোধ ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ছিল এই বরেণ্যার, কীভাবে পশ্চাৎপৎ-জাতিতত্ত্বকে চ্যালেঞ্জ করে নানা লেখা লিখেছেন এই ‘বিদেশিনী’। এ-গ্রন্থের পাতায়-পাতায় বিস্ময়। কখনো পুরনো বিতর্কের যুক্তিসিদ্ধ জবাব, কখনো নতুনতর বিতর্কের প্ররোচনা। এ-গ্রন্থের চালচিত্রে জাতীয় আন্দোলন। তাই এই আন্দোলনের রূপ ও প্রকৃতি বিষয়ে আলোচনায় প্রাসঙ্গিকভাবেই যুক্ত হয়েছে বহু নতুন তথ্য। স্বদেশী বহু বিখ্যাত নেতা সম্পর্কেও ধারণা বদলে দেবে এইসব তথ্যের উদ্ঘাটন। দুষ্প্রাপ্য ফ্যাকসিমিলি ও ছবির এক বিরল সংগ্রহ এ-গ্রন্থের আলাদা আকর্ষণ।