‘অনেকদিন ধরে একটি প্রচ্ছন্ন অভিমানে ভুগেছি’, বছর তিনেক আগে লিখেছেন তিনি। কার ওপর অভিমান? কেনই বা? সমাজের ওপর, সমাজের সুবিধাভোগী শ্রেণির ওপর। অগণিত মানুষ ‘দারিদ্র্যের চরম সীমায়, অনাহারে-অর্ধাহারে দিন গুজরান’ করছেন, অথচ ‘এই সব জেনেই শিক্ষিত বাঙালিরা আত্মতৃপ্তিতে গদগদ’। এই ভয়ানক এবং মর্মান্তিক বৈষম্য প্রবীণ মানুষটিকে পীড়া দেয়। এ তো কেবল আর্থিক বৈষম্য নয়, শুধু সামাজিক বিভেদও নয়, তার সঙ্গে সম্পৃক্ত এক গভীর মানসিক বৈষম্যও। তার উপলব্ধি অশোক মিত্রকে সারা জীবন তীব্র মানসিক যন্ত্রণা দিয়েছে, তাঁকে অভিমানী করেছে। সমাজের ওপর, সমবর্গীয় সহনাগরিকদের ওপর, এবং নিজের ওপরেও। এই সংকলনের বেশির ভাগ লেখাই আপাতদৃষ্টিতে স্মৃতিচর্চা। কিন্তু নানা প্রসঙ্গে ক্রমাগত যে সংবেদনশীল মনটির অভিজ্ঞান মেলে, তার গভীরে নিহিত আছে এক প্রগাঢ় সমাজদর্শন, যার প্রকৃত নাম শ্রেণিচেতনা।তাঁকে কোনও ছকে বাঁধা যায় না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিচারে তিনি অর্থনীতিবিদ। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপনা করেছেন, আবার বিভিন্নভাবে সরকারি নীতি রচনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন, যথা কেন্দ্রীয় কৃষিপণ্য মূল্য কমিশনের সভাপতি, ভারত সরকারের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী। পরবর্তী পর্বে রাজ্যসভার সদস্য হিসাবে সমৃদ্ধ করেছেন ভারতীয় সংসদকে। কিন্তু অর্থনীতি এবং রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিক বলয়ের বাইরে অর্ধ শতকের বেশি সময় ধরে তাঁর সতেজ উপস্থিতি সমাজকে ঋদ্ধ করে চলেছে। বস্তুত, তাঁর চিন্তা এবং লেখালিখির ভুবন আদিগন্ত বিস্তৃত। বহু মূল্যবান গ্রন্থ ছাড়াও পত্রপত্রিকায় লিখেছেন অগণিত প্রবন্ধ। সমাজমনস্কতার প্রেরণায় নব্বই উত্তীর্ণ বয়সে এবং বহুবিধ শারীরিক অসুবিধা সত্ত্বেও পাক্ষিক পত্রিকা ‘আরেক রকম’-এ সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। ‘সমাজে টিকে থাকার বাধ্যবাধকতা,তাই খুব বেশি আরেকরকম হয়ে থাকা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব নয়’-নিজের এই কথার মূর্তিমান প্রতিস্পর্ধা অশোক মিত্র নিজেই। সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত (১৯৯৭)।