স্মৃতি উসকে দেয়া বই বিস্মৃত কথকতা। বইয়ের লেখক মুহিত হাসান অনতিতরুণ বয়সেই এমন গুরুতর বিষয়পথে কলম চালিয়েছিলেন যে পথে সহজে কেউ যেতে চায় না। পর্যাপ্ত তথ্যের যোগান, স্বচ্ছ ইতিহাসজ্ঞান আর বিশ্লেষণের যথাপ্রযুক্ততা ব্যতীত এই বইয়ের কাঠামো নির্মাণ সম্ভব হতো না। মুহিত হাসান এইসব গুণ বা বৈশিষ্ট্য যা-ই বলি, অর্জন করে ফিরে তাকিয়েছেন বাঙালি ইতিহাসের বিচিত্র-বর্ণিল প্রেক্ষায়; ফলত বাঙালির চা-পান, সার্কাস সাধনায় বাঙালি, সেকালের বাংলায় সাইকেল-ভ্রমণ : এক সাহেবের সাক্ষ্য, বাংলায় এলো রেল : ভোগান্তি ও কৌতূহল, দুই দারোগার কাহিনি : মিয়াজান ও বাঁকাউল্লা শীর্ষক পাঠ-সুখকর রচনাগুচ্ছের জন্ম। ইতিহাসকে কেবল শুষ্কং কাষ্ঠং বিষয় হিসেবে নয় বরং যৌগিক পাঠ হিসেবে প্রতিষ্ঠার প্রয়াস লেখকের। তাই বাঙালির চা নিয়ে লিখতে গিয়ে শুধু এ অঞ্চলের খাদ্য-সংস্কৃতি নয় একই সঙ্গে বাংলায় ইংরেজের চা-ব্যবসায়ের আদ্যোপান্ত তুলে ধরেন। বাঙালির সার্কাস সাধনা নিয়ে আলোচনার অবতারণা করতে গিয়ে সার্কাসের ইতিবৃত্তের পাশাপাশি বাঙালির সমষ্টি-উদ্যোগের উত্থান-পতনকেও নির্দেশ করেন। এক সাহেবের সাক্ষ্যে সাইকেল ভ্রমণের বৃত্তান্ত পড়তে পড়তে তৎকালীন বাংলার ভূপ্রকৃতিরও দেখা মেলে। বাংলায় রেল নিয়ে রচনাটিতে এ অঞ্চলের সমাজমানস ও সাহিত্যকর্মে রেলের কু-ঝিকঝিক প্রভাবধ্বনি বাক্সময় হয়েছে। ইংরেজ আনুকূল্যে বাঙালি দুই দারোগার গাল-গপ্পের মধ্য দিয়ে উপনিবেশিত সমাজের একটি বিশেষ শ্রেণির অবয়ব উন্মোচিত। ভূমিকাবাক্যে অশীন দাশগুপ্তের শরণ নিয়ে মুহিত বলেছেন যে ইতিহাস ও সাহিত্যের গুরুচণ্ডালি নিয়ে তিনি সতর্ক। আমরা বলি বইটি পড়তে গিয়ে পাঠক ইতিহাস ও সাহিত্যের ভেদরেখা মনে না রেখেও সম্ভোগ করবেন ইতিহাসের সত্য ও সাহিত্যের আনন্দ। এটা লেখকের অন্তর্বয়ান, বিষয়বিন্যাস ও ভাষাশৈলীর ফল। পাঠক আসুন, মুহিত হাসানের বিস্মৃত কথকতায় প্রবেশ করুন, ইতিহাস ও সাহিত্যের যুগল আস্বাদ নিন।
পিয়াস মজিদ