শুধু ভারতের ইতিহাসেই নয়, পৃথিবীর সর্বকালের ইতিহাসে এক অত্যাশ্চর্য মানুষের নাম—বিবেকানন্দ। মাত্রই ঊনচল্লিশ বছরের স্বল্পায়ু জীবন। তার মধ্যে প্রকৃত-অর্থে পরিচিতি যখন শুরু, তাঁর বয়স তখন বাইশ-তেইশ। সেও অতি সীমাবদ্ধ পরিসরে। কিন্তু যুবক নরেন্দ্রনাথকে ঠিকই চিনে-বেছে নিয়েছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। শ্রীরামকৃষ্ণের দেহাবসানের পর শুরু হয় তাঁর পরিব্রাজকের জীবন। বেশ কয়েক বছর কাটে তাঁর ভারতের নানা প্রান্ত ভ্রমণে। এই ভ্রমণের ফলে একদিকে ভারতীয় জনজীবন সম্পর্কে যেমন তাঁর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বৃদ্ধির সুযোগ ঘটে, অন্যদিকে আপামর জনসাধারণও উদ্দীপিত হবার সুযোগ পান তাঁর প্রেরণাসঞ্চারী বাণীতে। এর পরের ঘটনা আরও বিস্ময়কর। ভারতের সাধারণ মানুষেরা সম্মিলিত চাঁদার অর্থে সুদূর আমেরিকা পাঠায় স্বামীজীকে। শিকাগো ধর্মমহাসভায় যোগদানের জন্য স্বামীজীকে অনুরোধ জানিয়ে হাভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাইট সেইসময় ধর্মমহাসভা-কমিটির চেয়ারম্যানকে সেই-যে লেখেন, ‘আমাদের সমস্ত অধ্যাপককে এক করলে যা হবে, এই সন্ন্যাসী তার থেকেও বেশি পণ্ডিত’—সে-কথাই যেন অক্ষরে-অক্ষরে প্রমাণ করলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁর অবিস্মরণীয় বক্তৃতা তথা কীর্তি আজ ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক উজ্জ্বলতম ঘটনা। সুদূরপ্রসারী ও কালাতিক্রমী তার প্রভাব। আজও ফুরোয়নি তার রেশ। একশো বছর পরেও নতুন করে পঠনপাঠন, আলোচনা-গবেষণার মধ্য দিয়ে চলছে তার যথার্থ তাৎপর্য অন্বেষণ। দেশে ফিরেই স্বামীজী সূচনা করেছিলেন বিরাট কর্মযজ্ঞের। জীবনের সর্বক্ষেত্রে আলোড়ন তুলেছিল তাঁর চিন্তাধারা। দ্বিতীয়বার বিদেশসফর শেষে স্বদেশে ফিরে শেষ কয়েকটি বছর অসুস্থ শরীর নিয়েও দেশবাসীকে পথনির্দেশ করে গেছেন তিনি। সেই পথ যে কত সঠিক, তার প্রাসঙ্গিকতা যে কত সময়জয়ী, আজ তা নতুন করে ধরা পড়ছে যেন। শুধু ধর্মনেতা বা ‘সাইক্লোনিক হিন্দু’ রূপেই নয়, স্বামী বিবেকানন্দ শাশ্বত হয়ে থাকবেন এক পূর্ণ মানুষ, আদর্শ পুরুষসিংহের এক উজ্জ্বল প্রতীক হিসেবে। বিবেকানন্দের জীবন ও কীর্তি ভারতবর্ষের ইতিহাসের কোনও এক বিশেষ দিক বা অধ্যায়ের অংশমাত্র নয়। তাঁর ভূমিকা তথা অবদান খণ্ডিত করে দেখা সম্ভবপর নয়। অথচ এই মহান অখণ্ড জীবনকে ধরা বা বোঝাও অতি দুঃসাধ্য। তাই কেবলই চলছে বিবেকানন্দ-নিরীক্ষা, বিবেকানন্দ-মূল্যায়ন। নানা জানালা, নানা কোণ, নানা দৃষ্টির মধ্য দিয়ে। আর, বিস্ময়ের বিষয় এই যে, এত কিছুর পরেও যেন অজানা রয়ে গেছে সম্পূর্ণ মানুষটি। তাঁর জীবনের সমস্ত ঘটনার কথা এখনও যেমন জানা সম্ভব হয়নি, তাঁর রচনা ও বক্তৃতার সবটুকু যেমন এখনও অনাবিষ্কৃত, তেমনই আজও অনুদ্ঘাটিত এই মহাপুরুষের প্রকৃত পরিচয়টি। তাই বিবেকানন্দ বিষয়ে রচনার, বিবেকানন্দ পরিক্রমার কোনও শেষ নেই। বিবেকানন্দের কর্ম ও মনন, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ভাবান্দোলন বর্তমান ভারত তথা বিশ্বের শুধু চর্চার বিষয় নয়, জীবনচর্যারই বিষয়। বিবেকানন্দ চিরন্তন, বিবেকানন্দ শাশ্বত। সেই শাশ্বত ঐতিহাসিক পুরুষটির জীবন ও চিন্তার ভিন্নভিন্ন দিকগুলিকে নিয়েই বিশ্লেষণ এই গ্রন্থে। রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশন এবং সারদা সঙেঘর সন্ন্যাসী ও সন্নাসিনীবৃন্দ, যাঁরা স্বামীজীর ভাব ও আদর্শের সঙ্গে সুপরিচিত—তাঁরাও যেমন লিখেছেন এখানে, তেমনই বিবেকানন্দের বিভিন্ন দিক নিয়ে লিখেছেন প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের কিছু বিদগ্ধ মানুষও। এঁদের মধ্যে আছেন গৌরী ধর্মপাল, স্বামী জিতাত্মানন্দ, প্রব্রাজিকা ভাস্বরপ্রাণা, স্বামী হিরন্ময়ানন্দ, প্রব্রাজিকা বেদান্তপ্রাণা, স্বামী সোমেশ্বরানন্দ, স্বামী প্রভানন্দ, বীরেন্দ্রকুমার ভট্টাচার্য, স্টুয়ার্ট এল্ক্ম্যান, নিশীথরঞ্জন রায়, স্বামী লোকেশ্বরানন্দ, পাপিয়া চক্রবর্তী, ডিয়েটমার রদারমন্ড, শঙ্করীপ্রসাদ বসু, উজ্জ্বলকুমার মজুমদার, বিনায়ক কৃষ্ণ গোকক, স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ, সান্ত্বনা দাশগুপ্ত, মার্টিন কেয়ম্পশন, হোসেনুর রহমান, প্রব্রাজিকা আত্মপ্রাণা, এস. এ. মাসুদ ও সংকলন-সম্পাদক নিমাইসাধন বসু। নতুনতর তথ্যে ও তত্ত্বে, যুক্তিতে-তর্কে, বিচারে ও বিশ্লেষণে বিবেকানন্দের জীবন ও মনন সম্পর্কে এক অপরিহার্য সংযোজন এই সংকলিত প্রবন্ধ-গ্রন্থ।