সনৎকুমার সাহা গদ্য অঙ্কন করেন; অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেভাবে ছবি লিখতেন। এই সিদ্ধান্তে আমরা নিঃসংশয় অন্তত এলোমেলো হাওয়া শীর্ষক প্রবন্ধগ্রন্থের পাঠান্তে। ষোলটি ভাবনা ও ভাষাদীপ্ত প্রবন্ধপুষ্পে গেঁথে তোলা ফুল যেন এই বইটি। প্রারম্ভ যদি ‘স্বপ্ন ও বনলতা সেন’ দিয়ে পরিশেষ তবে ‘ভাষা-সাহিত্যের রাজ্যপাট : ভাঙনের শব্দ শুনি’তে। তাৎপর্য আছে বৈকি! স্বপ্ন থেকে ভাঙন অবধি এক দুস্তর পরিক্রমাই তো তিনি বয়ন করে তুলেছেন মেধাবী তন্তুতে। কত সিন্ধু কত দিগন্ত মন্থন তাঁর! জীবনানন্দ থেকে হাসান আজিজুল হক, কুন্ডেরা থেকে মাহমুদুল হক, মেঘদূত-মহাভারত থেকে কমনওয়েলথ সাহিত্য, বিষ্ণু দে থেকে মোহাম্মদ রফিক, জুলিয়াস ফুচিক থেকে নাজিম মাহমুদ ইত্যাকার কতবিধ ধ্রুবপদ যে বেঁধেছেন সনৎকুমার সাহা তাঁর অপ্রতিম অনুভবে-অনুধ্যানে; ভাবলে অবাক মানতে হয়। এই তারল্যপ্রধান গদ্যের রাজত্বকালে এ নেহায়েত ব্যতিক্রমী গদ্য নয়; সাহিত্যভোক্তার পাতে এমন মহার্ঘ্য ব্যঞ্জনপ্রাপ্তি এখন সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার।
ভূমিকা-কথনে লেখক জানান : ‘লেখাগুলো বিভিন্ন সময়ের... বিষয় যখন যেমন মাথায় এসেছে তেমন’। কিন্তু আমরা বলি আপাত বিক্ষিপ্ততার আড়ালে এই বইয়ের মূল বৈচিত্র্য নিহিত। ভিন্ন ভিন্ন বিষয়ে রচিত সারগর্ভ ব্যাখ্যান মিলেমিশে তৈরি করে এক অখণ্ড বোধিভাষ্য যার কাছে বিধিবদ্ধ ধারাবাহিকতা ম্লান, অনুজ্জ্বল। স্বতন্ত্র চিন্তাকণা সমবায়ে যে সৌধের নির্মাণ ঘটে পাঠকের মননে তা যুগপৎ বহুতলস্পর্শী ও ঊর্ধ্বাকাশী। ধ্রুপদী থেকে সমকালীন সাহিত্য পর্যন্ত এলোমেলো হাওয়া-র বিস্তার। আবার এর পুরো প্রাঙ্গণ জুড়েই রয়েছে সাহিত্যের সূত্রে সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতি-অর্থনীতির সুবিপুল সম্ভোগ। ইতিহাসের অজস্র প্রান্ত এসে গঠন করে লেখকের ভাবনাকেন্দ্র। তাই দেখি মহাভারতের সৌতি থেকে শুরু করে ধর্মপুরুষ ইসমাইলের কাহিনিরও সমান উপস্থিতি।
নানা বর্ণের ভাবনামালা যে অভূত রূপবন্ধনে গ্রথিত করেছেন সনৎকুমার সাহা, তার পরিমিতি ও প্রসারণ, টুকরো কথার সংহতি, শব্দ ও চিন্তার সমবিচ্ছুরণ আমাদের গদ্যচর্চাকে নতুন দিশা নির্দেশ করবে নিঃসন্দেহে।
পিয়াস মজিদ
কবি ও প্রাবন্ধিক